শুক্রবার ০৩ মে ২০২৪
Online Edition

ছয় মাসে শতাধিক যুবক মানবপাচারের শিকার ॥ পণবন্দী হয়ে অত্যাচারিত নির্যার্তিত

শেখ মোঃ সামসুদ্দোহা মাদারীপুর থেকে : সমুদ্র পথে ইটালী নেয়ার কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে বাংলাদেশের হাজার হাজার যুবককে জিম্মি করে মুঠোফোনে ইমোতে অত্যাচারের অডিও ভিডিও স্বজনদের দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার মূল হোতারা অবেশেষে সনাক্ত হয়েছে। লিবিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশী ও ওই দেশের দুষ্কৃতিকারীদের  মূল হোতা বা মূল মাফিয়া মাদারীপুরের কালকিনির শিকারমঙ্গলের মিরাজ হাওলাদার। মিরাজের নেতৃত্বেই এদেশের আরো বেশ কয়েকজন দুষ্কৃতকারী লিবীয়দের নিয়ে অন্তত ১৫ থেকে ২০টি গ্রুপ তৈরি করে লিবিয়াজুড়ে অপহরণ মাফিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। সম্প্রতি লিবিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের সহায়তায় র‌্যাব-৮ মাদারীপুর ক্যাম্পের টানা অভিযানে ভয়ংকর এই মাফিয়া চক্রের সন্ধান মিলেছে। ইতোমধ্যে র‌্যাব মিরাজের স্ত্রীসহ মাফিয়া গ্রুপটির কয়েকজন পারিবারিক সদস্যদের গ্রেফতারও করেছে।  লিবিয়ায় জিম্মি ও মুক্তিপ্রাপ্তদের কাছ থেকেও পাওয়া গেছে মিরাজ ও তার মাফিয়া বাহিনীর অত্যাচারের লোমহর্ষক তথ্য।  

 একাধিক সূত্রে জানা যায়, লিবিয়ায় গাদ্দাফী বিরোধী যুদ্ধের পর সেদেশের সমুদ্রপথ ব্যবহার করে ইটালীতে অধিবাসীদের ঢল নামে। সেই থেকে মাদারীপুরসহ সারাদেশের যুবকদের ইটালী যাওয়ার মূল গন্তব্য হয়ে উঠে লিবিয়া রুট। ভাগ্যের উন্নয়নে এযেন ঢল নামে লিবিয়ামুখে। সমুদ্র পথে মৃত্যুও ঘটে বহু বাংলাদেশীর। যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করায় গত ৫/৬ বছর ধরেই লিবিয়ায় গিয়েই মাফিয়া, গ্যাং বা অপহরণকারীদের নামে হাজার হাজার বাঙ্গালীকে অপহরণ করে জিম্মির পর মুঠোফোনে ইমোতে অত্যাচারের অডিও ভিডিও স্বজনদের দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছিল। গত ৬ মাসে মাদারীপুরেরই ৪ উপজেলার অন্তত শতাধিক যুবককে অপহরণের ঘটনা ঘটে ও একই কায়দায় মুক্তিপন আদায়  চলছিল। অপহৃতদের পরিবারগুলো সন্তানদের বাঁচাতে বাধ্য হয়ে জমিজমা বাড়ি ঘর বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে এদেশীয় দালালদের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করেও দফায় দফায় নির্যাতনের শিকার হতো। ভুক্তভোগীদের কয়েকজন র‌্যাব-৮ মাদারীপুর ক্যাম্পে অভিযোগ দিলে গত ৩ মাসে এদেশীয় সহযোগী ৮ জনকে গ্রেফতার করে । মুক্তিও পায় অন্তত ১৬ জিম্মি।  অব্যাহত তদন্তে মাদারীপুর র‌্যাব ক্যাম্প স্বপ্রণোদিত হয়ে লিবিয়ায় হাইকমিশনের সহায়তা নিয়ে যৌথ তদন্তে নিশ্চিত হয় লিবিয়াজুড়ে চলা এই অপহরণ চক্রের মূল হোতা জেলার কালকিনি উপজেলার শিকারমঙ্গল ইউনিয়নের মৃধাকান্দি গ্রামের হোসেন হাওলাদারের ছেলে মিরাজ হাওলাদার । মাত্র ৬ বছর আগে মিরাজ লিবিয়ায় যাওয়ার পর যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে রাজৈরের মনির, সুমন, ফরিদপুরের নগরকান্দার ২ ভাই সোহাগ, আলমগীর, ময়মনসিংহের রাজেলসহ অন্তত ২০-২৫ জন বাংলাদেশী দুষ্কৃতিকারীকে নিয়ে গড়ে তোলে ১৫-২০টি সশস্ত্র মাফিয়া বা অপহরণ গ্রুপ। অপহৃতদের পরিবারদের  লিবিয়ান মাফিয়া বা পুলিশকে বোঝাতে দলে ভেড়ায় সে দেশের দুষ্কৃতকারীদের। এভাবেই মিরাজ এর গ্যাং লিবিয়াজুড়েই হাজার হাজার বাংলাদেশী অপহরণ অমানবিক নির্যাতন করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। টাকা আদায়ে মিরাজসহ গ্যাং সদস্যরা তাদের মা বাবা বৌসহ স্বজনদের ব্যাংক ও বিকাশে মুক্তিপণের টাকা জমা নিত।  তদন্তে নিশ্চিত হয়ে র‌্যাব ইতোমধ্যেই গ্রেফতার করেছে গ্যাং লিডার মিরাজের স্ত্রী ও শ্বশুর,আরেক হোতা রাজৈরের সুমনের বাবা-মা, ও মনিরের বাবাকে। পলাতক রয়েছে পরিবারগুলোর প্রায় সব সদস্য। মিরাজের বেকার শ্যালকের স্ত্রীর এক ব্যাংক একাউন্টেই পাওয়া গেছে প্রায় ২৫ লাখ টাকার উপস্থিতি। গ্যাং সদস্যদের মাত্র কয়েক বছরেই গ্রামের বাড়িগুলো যেন সা¤্রাজ্য ও অট্টালিকায় রূপ নিয়েছে।  মিরাজের গ্যাংয়ের চাহিদা মোতাবেক কয়েকদফা লাখ লাখ টাকা দিয়েও মুক্তি না পেয়ে চরম আতংকে অসংখ্য পরিবার। অনেকেই এখনো জিম্মি রয়েছে মিরাজের গ্যাং গুলোর হাতে।

সরেজমিনে মিরাজের কালকিনির শিকারমঙ্গলের মৃধাকান্দি গিয়ে দেখা যায়, গ্যাং লিডার মিরাজের ২ তলার অত্যাধুনিক বাড়িতে এক ফ্লোরেই বারটি রুম। ফার্নিচারগুলোও বেশ দামী। প্রতিটি শোবার রুমেই হাতে বানানো দামী দামী খাট। ফার্নিচারগুলোও ভাল মানের। তার হঠ্যাৎ উত্থ্যানে বিস্মিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ এলাকার মানুষ। অপরদিকে গ্যাং এর অপর ২ সদস্য ফরিদপুরের নগরকান্দার ২ ভাই সোহাগ, আলমগীর বাড়িতে একইসাথে ৪টি বহুতল ভবনের কাজ ধরেছে। একইভাবে এই চক্রের অপর সদস্যদেরও হঠ্যাৎ ফেলেফুপে উঠার বিষয়টি সকলেরই কাছেই বিস্ময়। 

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক লিবিয়ায় জিম্মি এক যুবকের স্ত্রী বলেন, আমার স্বামী এক বছর আগে লিবিয়া যাওয়ার পর ইটালী নেওয়ার কথা বলে আজ নয় মাস যাবত মিরাজ ও তার গ্যাংয়ের লোকজন জিম্মি করে রেখেছে। ওরা তার উপর অমানুষিক নির্যাতন করে মোবাইলে ভিডিও কলের মাধ্যমে আমাকে দেখিয়ে মুক্তিপন বাবদ টাকা দাবী করে। টাকা না দিলে আমার স্বামীকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এ পর্যন্ত ৪ লাখ টাকা দিয়েছি তবুও ওরা আমার স্বামীকে ছাড়েনি। আমি আমার স্বামীকে ফেরত চাই।

আরেক জিম্মি যুবকের ভাই বলেন, আমার ভাইসহ মিরাজ আমার এলাকার আঠারো জন যুবককে জিম্মি করে রেখেছে। ছয় জনের মুক্তিপন বাবদ মিরাজের স্ত্রী, বাবা ও ভাবির ব্যাংক এ্যাকাউন্টে আমি নিজে এ পর্যন্ত নয় লাখ টাকা দিয়েছি। তবু কাউকে ছাড়েনি। মিরাজের সাথে এই চক্রে লিবিয়ানরা ছাড়াও রাজৈরের মনির, সুমন , ফরিদপুরের নগরকান্দার সোহাগ, আলমগীর, ময়মনসিংহের রাজেলসহ ২০-২৫ জন রয়েছে বলে আমার ভাই আমাকে জানিয়েছে।

মিরাজ মাফিয়া গ্যাং থেকে মুক্তিপন দিয়ে মুক্তি পাওয়া শরীয়তপুরের বোরহান জমাদ্দার বলেন, আমার বাবা জমি বিক্রি করে আমাকে লিবিয়া পাঠিয়েছিল। আমি সেখানে ত্রিশ হাজার টাকা বেতন পেতাম। এই মিরাজ ইটালী নেওয়ার কথা বলে আমাকে জিম্মি করে সিগারেটের আগুন দিয়ে শরীরে ছ্যাকা দিত, বন্দুকের বাট, লোহার পাইপ, কোমরের বেল্ট দিয়ে পিটাতো। পানি চাইলে খালী বোতল দিত। নিজের প্রসাবই খেতে হতো। মোবাইলে ভিডিও কল দিয়ে আমার মা-বাবাকে তা দেখাতো। একবার টাকা দিয়ে ছাড়ার পর আবার ওর আরেক গ্রুপ মনিরের নামে আবার ধরে অত্যাচার করে ২ বার টাকা নেয়। ২ বারে  ঋন করে টাকা এনে সাড়ে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপন দিলে মিরাজ গ্যাং আমাকে ছেড়েছে।ওর গ্যাংগুলো হাজার হাজার যুবকের এভাবে জিম্মি কওে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আমি ওর বিচার চাই। 

অপহরনের শিকার মাগুরার বিদ্যুত নামের এক যুবক মুঠোফোনে বলেন, লিবিয়ায় মিরাজের সাথে ২০-২৫ জন অস্ত্রধারী লিবিয়ানও রয়েছে । আর বাংলাদেশী ২৫-৩০ জন রয়েছে তার পার্টনার। মিরাজই এই গ্যাংয়ের বস বা মাফিয়্।া বাংলাদেশে মিরাজের পরিবার ও আত্মীয় স্বজন সবাই এই চক্রের সদস্য। ওরা আমাদের হাজার হাজার যুবকদের জিম্মি করে মুক্তিপন আদায় করে বাংলাদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। এরা আমাদের উপর প্রতিনিয়ত অমানুষিক নির্যাতন করে। 

বিদ্যুতের সাথে একই রুমে থাকা আরো অন্তত ২০ জন বাংলাদেশী মুঠোফোনে ভিডিও কলে প্রতিবেদককে সিগারেটের ছ্যাকা-গভীর ক্ষত, অস্ত্রের আঘাতের চিহৃ দেখান। সবাই মিরাজ গং এর নির্মম নির্যাতনের অশ্রুসজল বর্ননা দেন এবং নিজেদেও অবর্ণনীয় কষ্টের কথা বলেন। অভিযোগকারীরা এসকল সনাক্ত হওয়া বাংলাদেশীদেও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে নিজেদেও মুক্তিপনের টাকা দাবি করেন। 

কালকিনির শিকারমঙ্গল ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল আলম মৃধা বলেন, ফোনে মিরাজের কাছে আমি এই অপহরনের বিষয় জানতে চাইলে সে বলে তার কাছে ১০-১২ জন লোক আছে বলে স্বীকার করেছে।  কিন্তু আমার জানামতে লিবিয়ায় একজন বাঙ্গালী সর্বস্ব ২৫-৩০ হাজার টাকা বেতন পায়। এই বেতনে মিরাজ তার বাড়িতে এত সম্পদের পাহাড় কিভাবে করছে তা আমার বোধগম্য নয়। মিরাজের এই অপকর্মের কারণে আমার ইউনিয়নের বদনাম হচ্ছে। আমি সরকারের কাছে এটার কঠোর বিচার দাবি করছি।

লিবিয়ায় বাংলাদেশী হাইকমিশনের লেবার কাউন্সিলর মোঃ আশরাফুল ইসলাম মুঠোফোনে ভিডিও সাক্ষাৎকারে জানান, যেহেতু লিবিয়ায় বর্তমানে কোন বৈধ পুলিশ বাহিনী নেই, মিলিশীয়ারা কোন রকমে কাজ চালাচ্ছে।  সেই সুযোগে বেশ কয়েকটি অপহরণকারী চক্র অপহরণ ব্যবসায় নেমেছে। তার মধ্যে মিরাজের গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে গত ৫-৬ মাসে অন্তত ৫০ টি অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। আমরা মন্ত্রণালয়, এদেশীয় ও আমাদের দেশীয় আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে বিষয়টি জানিয়েছি। তার মধ্যে র‌্যাব-৮ এর দুঃসাহসিক অভিযানের মাধ্যমে মিরাজসহ তাদের কয়েকজনের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় জানা গেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই গ্রুপটিকে ধরতে আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছি।

র‌্যাব-৮ মাদারীপুর ক্যাম্প কমান্ডার মেজর মোঃ রাকিবুজ্জামান বলেন, লিবিয়াতে এ পর্যন্ত আমরা যতগুলো অপহরনকারী গ্যাং পেয়েছি এদের সবার মাফিয়া ডন বা মূল নেতাই মিরাজ। গ্যাংটি খুব ভয়ংকর। তার সাথে যে সকল লিবিয়ান সদস্য রয়েছে তাদের নাম আমরা জানতে পারিনি তবে বাংলাদেশী যে কয়জন সদস্য রয়েছে তাদের নাম ও পরিচয় জানতে পেরেছি। এরা অত্যান্ত ভয়ংকর। এরা হাজার হাজার বাঙ্গালী যুবককে জিম্মি করে অমানুষিক নির্যাতন করে মোবাইলে ভিডিও কল দিয়ে তাদের পরিবারের সদস্যদের নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা মুক্তিপন আদায় করে। এই চক্রের যে সকল সদস্য বাংলাদেশে বসে মুক্তিপণের টাকা আদায় করছে তাদের মধ্যে আট জনকে আমরা আটক করেছি। বাকিদের ধরতে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আর এই চক্রের লিবিয়ান সদস্যদের ধরতে লিবিয়ান হাইকমিশন ও আমরা একযোগে কাজ করছি।ম এ চক্র শনাক্তর ফলে আন্তজার্তিকভাবে বহুল আলোচিত এ রুটটি বন্ধে বড় ধরনের ভূমিকা হিসেবে কাজ করবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ